Sharadiya Magazine of BCS has been a sought-after platform for our budding artists and literature lovers. We are attempting to collect, digitize and re-publish the back issues.
ফেলে আসা দিনগুলি – সুবর্ণ জয়ন্তীর আবেদন
সুজয় দত্ত
ছেলেবেলায় একবার ভাইয়ের হাত ধরে রাসমেলায় গিয়েছিলাম। বাড়ী থেকে একটু দূরে রাসমণিবাজারের লাগোয়া মাঠটায় জমিয়ে রাসমেলা বসতো তখন। টাটকা ঝালমুড়ি, গরমাগরম জিলিপি, ফুলুরি-আলুর চপ, টমটম গাড়ী, কথাবলা পুতুল, নাগরদোলা — আরো কত কী। বেশী না, বড়জোর দুটো বাসস্টপের দূরত্ব। কিন্তু তখন প্রাইমারী ইস্কুলে পড়ি, পাড়ার মাঠটুকু ছাড়া একা একা কোথাও যাওয়া বারণ। তাই ব্যস্ত বাসরাস্তা পেরিয়ে পুঁচকে ভাইকে নিয়ে সকলের অগোচরে অতদূর হেঁটে হেঁটে যাওয়ার মতো বৈপ্লবিক অপরাধের শাস্তি হয়েছিল পুরো একদিন একটা ঘরে বন্ধ থাকা। দুজনেই। তারপর আজ চার দশক পেরিয়ে গেছে। সেই ভাইও নেই, সেই রাসমেলাও নেই। কিন্তু ভাইরাস আছে! আর তার ঠ্যালায় ঘরে বন্দী থাকার শাস্তিও। বিনা অপরাধে।
অবশ্য করোনা ভাইরাসের কড়া শাসনে বছরখানেক কাটার পর একটা জিনিস পরিষ্কার — সারা পৃথিবীকে কাবু করলেও বাঙালীকে কিস্যু করতে পারেনি এই ভাইরাস। তার কারণও আছে যথেষ্ট। প্রথমতঃ জোড়াসাঁকোর নোবেল লরিয়েট এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বহুদিন আগেই বাঙালী জাতিকে সাবধান করে গেছেন তাঁর গানে — “একদিন চিনে নেবে তারে”। তাই চীনের মোকাবিলায় আগেভাগেই তৈরী ছিল তারা। দ্বিতীয়তঃ, এই করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় সবকিছু করা বন্ধ হয়ে গেছে বলে সারা বিশ্ব হাহুতাশ করছে, কিন্তু বাঙালী? একদমই না। বাচ্চাবেলা থেকে বুড়োবয়স অবধি হাজারবার ‘করোনা’-র মুখোমুখি হতে হতে জাতিগত ইমিউনিটি তৈরী হয়ে গেছে তার। “দুষ্টুমি করোনা”, “বাঁদরামি করোনা”, “হুটোপাটি করোনা”, “উঠতে দেরী করোনা”, “পড়ার সময় খেলা করোনা”, “বাসে ঝোলাঝুলি করোনা”, “পরীক্ষায় টোকাটুকি করোনা”, “যার-তার সঙ্গে প্রেম করোনা”, “ফালতু ঝামেলা করোনা”, “শরীরের অযত্ন করোনা” — ইত্যাদি শুনতে শুনতে “করোনার” অ্যান্টিবডিতে টইটম্বুর হয়ে রয়েছি আমরা। আমাদের মারে কে? তবে হ্যাঁ, একটা আশংকা রয়েই যাচ্ছে। চীনারা যদি এরপর কোনোদিন “খেয়োনা” বা “আড্ডা মেরোনা” ভাইরাস ছেড়ে দেয় বাজারে, তার ধাক্কা আমরা সামলাতে পারব কি? খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা মারা বন্ধ হয়ে গেলে বাঙালীর বাঙালিত্ব বলে কিছু থাকে নাকি?
যদি থাকে, তার নাম সাহিত্যচর্চা। গত একবছরে সারা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর সমীক্ষা হয়েছে করোনা-মহামারীতে মানুষ কী হারানোর অভাব বোধ করেছে সবচেয়ে বেশী, তাই নিয়ে। যতদূর জানি, একমাত্র বাঙালীরা — হ্যাঁ, এই ইলিশ আর রসগোল্লা-খেকো ভেতো বাঙালীরাই শুধু সেখানে সাহিত্যের জন্য হাহাকার করেছে। বলেছে, “ইস, পুজোসংখ্যাগুলো ঠিকঠাক হাতে পেলাম না এবার….” বা “ধুস, এবার কলকাতায় বইমেলাটাই হলনা?” বাঙালীর এই আক্ষেপে অবিশ্যি আশ্চর্য্যের কিছু নেই। খুঁজে দেখুন — আর কোনো ভাষাগোষ্ঠী পাবেন না যারা বছরভর তাদের প্রায় প্রত্যেকটি বড়বড় উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে একটা করে সাহিত্যসৃষ্টি-সমৃদ্ধ স্যুভেনির বা পত্রিকা বার করে। সে বাংলা নববর্ষই হোক বা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, বঙ্গসম্মেলনই হোক বা শারদোৎসব। আর এই শেষোক্ত উপলক্ষ্যটিতে বেরোনো পুজোসংখ্যাগুলো তো যুগযুগ ধরে বাঙালীর দুর্গাপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই শুধু নয়, প্রায় তার সমার্থক হয়ে গেছে। বিদেশে জন্মানো এবং বড় হওয়া আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের পক্ষে এটা বোঝা খুবই দুরূহ যে কীভাবে সর্বাঙ্গে প্রিন্টিং প্রেসের গন্ধমাখা রংবাহারী মলাটের এই বইগুলো বছরের পর বছর ধরে আসল ঢাকে কাঠি পড়ার বহু আগেই পুজো-মরশুমের উদ্বোধন ঘোষণা করে আসছে। নানা স্বাদের নানা রসের সাহিত্যসম্ভার নিয়ে মহালয়ার আগে ওই বইগুলো হাতে না এলে কেমন একটা “কী নেই কী নেই” ভাব — যেন ফুচকা খেতে গিয়ে বাদ পড়ে গেছে তেঁতুলজল বা খিচুড়ির সঙ্গে জোটেনি বেগুনভাজা। বিদেশের মাটিতে অবশ্য শিরশিরে শরতের সকালে ড্রাইভওয়েতে ডেলিভারি-বয় ছুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে পুজোসংখ্যা আনন্দমেলা বা নিউজ-কিয়স্কে টাইম ম্যাগাজিন আর ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের পাশে দেশ — এসব এখনো স্বপ্নের পর্যায়ে। তাই এখানকার বিভিন্ন পুজোকমিটি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায় তাদের নিজস্ব শারদপত্রিকার মাধ্যমে। অনেকক্ষেত্রেই যদিও তার পাতায় পাতায় বিজ্ঞাপনেরই আধিক্য (হাজার হোক মানিব্যাগটাও তো একটু দেখতে হবে), বেশ কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রমও আছে।
এটা বললে নিশ্চয়ই অতিশয়োক্তি হবে না যে আমাদের ক্লীভল্যান্ডের বঙ্গীয় সংস্কৃতি সংস্থা সেই ব্যতিক্রমগুলির একটি। আমাদের শারদপত্রিকায় প্রতি বছর যে সাহিত্যকর্ম আর শিল্পকর্মের সম্ভার থাকে, সে-‘ঘোলের’ স্বাদ বা গুণমান কিন্তু খাস কলকাতার মাদার ডেয়ারী বা মেট্রো ডেয়ারীর দুধের কাছে মোটেই দশ গোল খাবে না — বরং উল্টে দু-এক গোল দিয়ে দিতেও পারে। কিন্তু এ তো গেল প্রতি বছরের কথা। আগামী বছরটাতো আর যেমনতেমন বছর নয় — আমাদের সম্মিলিত গর্বের আর ভালোবাসার এই সংস্থার সুবর্ণজয়ন্তী। তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমরা যদি একটা স্মরণিকা সংকলন প্রকাশ করি, কেমন হয়? সেটা মুদ্রিত বা আন্তর্জালভিত্তিক হতে পারে — ধরা যাক দ্বিতীয়টিই। বিগত কয়েক দশকে এই সংস্থার যে স্যুভেনির বা পত্রিকাগুলি বেরিয়েছে, তাদের নির্বাচিত অংশ চয়ন করে তৈরী হবে এই সংকলন। ফেলে আসা সেইসব দিনের স্মৃতিকাতরতাকে উস্কে দিয়ে, টুকরো কথায় ছবিতে কবিতায় গল্পে আমাদের টাইম মেশিনে চাপিয়ে সাঁ করে নিয়ে গিয়ে ফেলবে স্মরণের বালুকাবেলায়। কত বিচিত্র ঘটনা আর বর্ণময় অভিজ্ঞতার স্মৃতি রঙীন ঝিনুকের মতো ছড়ানো সেখানে। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আর আমরা যা যা করবো সারাবছর, সেসবের রেশ যখন মিলিয়ে যাবে, ফিকে হয়ে আসবে উদযাপনের স্মৃতি — এই সংকলনটি আমাদের স্মৃতির সিন্দুক হয়ে রয়ে যাবে টাইম ক্যাপসুলের মতো।
অতএব আসুন, এই স্মরণিকা সংকলন প্রকাশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। বিগত পাঁচ দশকের সেই পত্রিকাগুলির কয়েকটি কি আপনার কাছে আজও আছে? তাহলে অনুরোধ রইল এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের সকলের সঙ্গে সেগুলি ভাগ করে নেওয়ার। এই ওয়েবসাইটে সেই সব পুরোনো পত্রিকাতে আপনি চোখ বোলাতে পারবেন আপনার অবসরে। এ-বিষয়ে বিশদ জানতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।